যুদ্ধ-পরবর্তী লিবিয়ায়  অবৈধভাবে জনশক্তি রফতানিতে জড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু প্রভাবশালী রিক্রুটিং  এজেন্সি। প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ছত্রছায়ায় অত্যন্ত  দাপটের সঙ্গে লিবিয়ায় অবৈধভাবে জনশক্তি রফতানি করছে এসব রিক্রুটিং এজেন্সি।  লিবিয়ায় নিয়োগদাতা কোম্পানির ওয়ার্কঅর্ডার কোন ধরনের যাচাই-বাছাই ও  বাংলাদেশ দূতাবাসের সত্যায়ন ছাড়া শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে লিবিয়ায়। ফলে যেসব  কর্মী লাখ লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যাচ্ছে, তাদের কাজের নিশ্চয়তা যেমন  থাকছে না তেমনি লিবিয়ায় বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির বাজারটিও দুর্নীতির  কারণে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
লিবিয়ায় গাদ্দাফি সরকারের পতনের  আন্দোলনের সময় প্রায় ৩৭ হাজার বাংলাদেশী কর্মী দেশটি থেকে চলে আসতে বাধ্য  হয়। লিবিয়ায় তেল উত্তোলন ও অবকাঠামো খাতে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা কাজ বন্ধ  করে দেশে ফিরে যান। গাদ্দাফি সরকারের পতনের পর এ পর্যন্ত লিবিয়ায় কোন  স্থায়ী সরকার ক্ষমতায় আসেনি। বিদেশী কোম্পানিগুলোও লিবিয়ায় ফিরে যায়নি।  লিবিয়ায় তাদের বন্ধ রাখা কোম্পানিগুলোও নতুনভাবে কাজ শুরু করেনি। তাই এসব  বিদেশী কোম্পানিতে কর্মরত অবস্থায় যেসব কর্মী বাংলাদেশে চলে এসেছিল তারা  এখনও যেতে পারেনি। কিন্তু লিবিয়ায় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই একশ্রেণীর  দালালচক্র প্রভাবশালী রিক্রুটিং এজেন্সির সহায়তায় ভুয়া ভিসা ও ওয়ার্কঅডারে  বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো শুরু করে। যা এখনও অব্যাহত আছে। বিএমইটির হিসাব  অনুযায়ী, যুদ্ধের পর এ পর্যন্ত প্রায় ১২ হাজার কর্মী সরকারি ছাড়পত্র নিয়ে  লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে। চোরাপথেও প্রায় সমপরিমাণ কর্মী লিবিয়ায় পাঠিয়েছে এই  চক্রটি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা  গেছে, লিবিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর জন্য যথাযথ ওয়ার্কঅর্ডার এবং বাংলাদেশ  দূতাবাস সত্যায়িত না করলেও ওপর মহলের চাপে আমরা ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হচ্ছি।  আমরা জেনেও অনেক সময় না বোঝার ভান করে এসব রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে  শ্রমিক পাঠানোর ছাত্রপত্র দিতে হচ্ছে। এতে লিবিয়ায় বাংলাদেশী জনশক্তির  বাজার যেকোন সময় আবারও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। মালয়েশিয়া ও কুয়েতের মতো  দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে সম্ভাবনাময় এই শ্রমবাজারটি। লিবিয়ায়  প্রায় ১০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি লিবিয়ার  ত্রিপলি বিমানবন্দর থেকে জাল ভিসার অভিযোগে প্রায় ৩শ’ বাংলাদেশী শ্রমিককে  ফেরত পাঠায় লিবিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ। এ সময় ত্রিপলিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের  কর্মকর্তারা চেষ্টা করেও তাদের দেশে ফেরত পাঠানো রোধ করতে পারেননি। এরপর  প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের  জানান, লিবিয়ায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত সেখানে কোন  বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানো হবে না। পরে কিছুদিন লিবিয়ায় জনশক্তি রফতানির  ছাত্রপত্র বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি সব কিছু  ম্যানেজ করে লিবিয়ায় নির্বাচিত সরকার আসার আগেই জনশক্তি রফতানি ফের শুরু  করেছে।
বিএমইটি সূত্র জানায়, লিবিয়ায় অবৈধভাবে শ্রমিক রফতানির অভিযোগে এ  পর্যন্ত ৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আরও বেশ কিছু  রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া  সম্ভব হচ্ছে না। অথচ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রভাব খাঁটিয়ে অবৈধভাবে  বাংলাদেশী শ্রমিকদের লিবিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। বিদেশে এসব শ্রমিকদের খণ্ডকালীন  কাজে লাগানো হচ্ছে কোন নিশ্চয়তার ডকুমেন্ট ছাড়াই। এ কারণে আগামী কয়েক মাস  পর এসব খণ্ডকালীন বাংলাদেশী কর্মী কর্মহীন হয়ে পড়বে। কোন বৈধ কাগজপত্র না  থাকায় এসব কর্মী আর তাদের ভিসা নবায়ন করতে পারে না। লিবিয়ার সংশ্লিষ্ট  বিভাগও অবৈধভাবে আসা কোন শ্রমিককে ভিসা দেবে না। তখন কর্মহীন অবস্থায়  বাংলাদেশী কর্মীদের রাস্তায় দিনযাপন করতে হবে, যেমনটি ২০০৭ ও ২০০৮ সালে  মালয়েশিয়ায় হয়েছে। জানা গেছে, জুনে বাংলাদেশ থেকে ৮৯০ জন কর্মী লিবিয়ায়  পাঠিয়েছে প্রভাবশালী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। আর মে’তে ৩ হাজার ১৭৩ জন,  এপ্রিলে ৪ হাজার ১৩৯ জন, মার্চে ১ হাজার ৭৬৪ জন, ফেব্র“য়ারিতে ১ হাজার ১৬২  জন এবং জানুয়ারিতে ৩৯২ জন কর্মীকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়েছে। এর বাইরেও জাল  ভিসায় হাজার দশেক কর্মী লিবিয়ায় পাঠিয়েছে দালালচক্র। এই চক্রটি ভ্রমণ ভিসায়  বাংলাদেশী শ্রমিকদের মিসর, তিউনিসিয়া, নাইজার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে নিয়ে  যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও এভাবে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে লিবিয়ায় যাওয়ার সময়  দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কয়েকশ’ বাংলাদেশী শ্রমিক। লিবিয়ার  সেনাবাহিনী এসব বাংলাদেশী শ্রমিকদের গুপ্তচর ভেবে প্রচণ্ড মারধর করে। পরে  তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কাজেই প্রভাবশালী রিক্রুটিং  এজেন্সিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ না করলে যেকোন সময় লিবিয়ার শ্রমবাজারটিও  বাংলাদেশের হাতছাড়া হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
 
                    
